Be Our Friend

কণ্ঠ, কেদারা আর ...


                                                                   (লেখায়  আকাশ দে )


              টা ঠিক তথাকথিত movie review না। content review?  তা বলা যেতে পারে। তবে এটা বিশ্লেষণ  বিশেষ আলোচনা,আগেই বলে রাখি।
শিল্পী,শিল্প, সমাজ এদের মধ্যে দন্দ্ব  চিরকালের। শিল্প আর  শিল্পীর মধ্যে কেবল একটা মাত্রার পার্থক্য ,যেমন প্রাণ আর প্রাণী। সেই "মাত্রা "টিকে মুছে ফেলার  গল্প বলে এই দুই  সিনেমা।
আগে গল্প দুটি  জেনে নেওয়া যাক, তার পর মাত্রার বার্তা দেওয়া যাবে।
শিবপ্রসাদ এবং নন্দিতা রায় এর "কণ্ঠ" আর ইন্দ্রদীপ  দাশগুপ্তের "কেদারা" অবশ্যই দুটো masterpiece.

 "কণ্ঠ" এর গল্প ঠিক এমন এক শিল্পীর কথা বলে যার কণ্ঠ ই ছিল সম্পদ। সকাল বেলায় চা এ চুমুক দিয়ে বা অলস হয়ে ক্যাব এ যেতে শোনেন, "আপনারা শুনছেন x .y Fm ...." বলা এক রেডিও জকি,বাচিক শিল্পী ছিল অর্জুন মল্লিক(চরিত্রে শিবপ্রসাদ মুখাৰ্জী )। তার "মন আমার" থেকে "জুজু" হয়ে ওঠার গল্প কণ্ঠ।
অর্জুন এর জীবন টা পাল্টে যেতে শুরু করে যখন ক্যান্সারের জন্য Larynx বাদ যায়। কন্ঠহীন এই সময় গুলো কণ্টকের মতো বিঁধতে থাকে তার শিল্পকে  ,তার শিল্পী সত্ত্বা কে। পরে কিছুটা দায় পরে ,বাধ্য হয়ে speech therapist  রোমিলা চৌধুরী(চরিত্রে জয়া আসান) এর সাহায্যে খাদ্যনালী হয়ে ওঠে তার কথা বলার নতুন বাকযন্ত্র। কণ্ঠ শব্দ  সাধারণের থেকে অনেকটাই বেমানান হলেও একজন বাচিক শিল্পীর কাছে বাচন ফিরে আসা কোনো বাঁচার থেকে কম নয়। তার শরশয্যা ক্রমে ক্রমে পরিণত হয় স্বরসজ্জায়। আর এই পুরো যুদ্ধে তার পাশে ছিল তার স্ত্রী পৃথা মল্লিক(চরিত্রে পাওলি দাম)।অর্জুন এখনকার কণ্ঠ নিয়ে আবার ফিরে আসে রেডিওতে, এক kids' show , "জুজু " এর anchor  হয়ে। কর্কট হারে জেদের কাছে ,ইচ্ছার কাছে , "কণ্ঠ" এর কাছে।
এ'তো গেলো এক বেঁচে ওঠার গল্প।

 'কেদারা' এক বাঁচতে চাওয়ার গল্প বলে। এখানেও 'নরসিংহ'(চরিত্রে কৌশিক গাঙ্গুলি) এর সম্বল তার কণ্ঠ। তবে সে একজন শব্দ শিল্পী, হরবোলা বা ventriloquist. তার এই শিল্প আজকের কেতাদুরস্ত সমাজে চলেনা। তার জীবনও তার শিল্পের মতো নিঃসঙ্গ। একাকী এক ভাঙা চোরা আধো আলো আধো অন্ধকারে ঢাকা ঘরে  সমাজে ফিরে পেতে চায় তার ছোট বেলাকে,অত্যন্ত কাছের মানুষ তার ঠাকুমাকে। এই শব্দ বদ্ব জীবনে তার একমাত্র সঙ্গী তার হারিয়ে যাওয়া ঠাকুমার "শব্দ"। কখনো তার মনে হয় এই আলোতে ঢাকা সমাজ ছেড়ে , শব্দ দ্বন্দ্ব খন্ড করে পাড়ি দিতে ঠাকুমার কোলে শুয়ে থেকে দেখা সেই চাঁদের দেশে , সেই কালপুরুষ ,সপ্তর্ষিমণ্ডলের দেশে, সেই স্কুলে যেখানে E for Egg Existence, S for Sweet  Struggle শেখায়। বাস্তব জগতে তার একমাত্র সঙ্গী পাড়ার মোড়ের ভাঙাচোরা পুরোনো ফেলে দেওয়া জিনিসের ব্যবসায়ী 'কেষ্ট'(চরিত্রে রুদ্রনীল ঘোষ) । এক "ভাঙাচোরা ফেলে দেওয়া" শিল্পীর এর থেকে প্রাসঙ্গিক বন্ধু কেউ হতে পারেনা।
ঘটনাচক্রে একদিন কেষ্টই নরসিংহের আবদার মতো এক পুরোনো কেদারা এনে দেয় ,সাথে একটা আয়নাও। বহুদিন পর "পুরোনো, দাপুটে" কেদারা পেয়ে, আয়নায় "নিজে"কে দেখে এই নর রূপী বুড়ো সিংহ টি তার হৃত গর্জন ফিরে পায়। তার আঁধার ঘেরা ঘরে যেন শান্তির পাখা ঝাপটে ঢোকে আলো।
কিন্তু কতদিন? এক বুড়ো ফেলে দেওয়া শিল্প ,তার যত দাপট ই  থাকুক, "সভ্যতা"কে ক্ষমতার বিনিময়ে বিক্রি করা সমাজ কেন মানবে? একদিন আঁতে ঘা লাগা স্থানীয় কাউন্সিলের রোষে পড়লে, ক্ষমতা কিটরা এসে নরসিংহের শব্দ ঘেরা সংসার ভাঙচুর করে। ভেঙে ফেলে সেই "কেদারা"টিও।
শেষ বেঁচে ওঠার সম্বল টুকু হারিয়ে ফেলা দাঁত নখ ভাঙা বুড়ো সিংহের আর  একটাই মাত্র পথ খালি ছিল...। শব্দ হলো নিঃশব্দ!

এখন এই দুটোকে আমি একই প্লটে কেন আনলাম? আমার মনে হয়েছে , এই বাঁচার লড়াইয়ে , শিল্প যুদ্ধে কোথাও যেন দুটো এক হয়ে গেছে। যেন দুটি জলধারা এসে মিশেছে একই নদী-প্রবাহে।
খুব তীব্র গতিতে পরিবর্তিত হওয়া ঝাঁ চক চকএ সমাজ ভুলে গেছে হ্যারিকেনের আলোয় মাখা সন্ধ্যেবেলার হিমেল বাতাসকে।রেডিমেড পোশাকের ড্যামির ভিড়ে ঊলের কাঁটাও আজ ধুলো জমে অতীত। কত শিল্প লড়ে ,শিল্পী লড়ে তার  খোঁজও রাখেনা। রাখবেই বা কিকরে "শিক্ষিত" সমাজ তো "struggle for existence"পড়েছে  "struggle for emotion" না। ফাটল ধরা সমাজের গায়ে যখনই শিল্প উঠছে ,নতুন বোধ উঠেছে ,তখনি জঞ্জালের মতো ছেঁটে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে বার বার। মানুষের জীবনে তো struggle আছেই , শিল্পীর জীবনে আরো বেশি। কেউ সব বাঁধা কাটিয়ে "অর্জুন মল্লিক" এর মতো বেঁচে ওঠে , কেউ "নরসিংহ"এর মতো আলো ঢাকা ক্ষমতার দড়িতে শিল্প ঝুলিয়ে  চিরতরে হারিয়ে যায়। শিল্পের কখনো পুরোনো নতুন হয়না।যখনই বাঁদরের দল গুহায় ছবি আঁকতে শিখলো ,তখনই প্রকৃতি বোধহয় বুঝে গেছিলো এরাই একদিন "শ্রেষ্ঠ" হবে। শিল্প মানবসত্ত্বার সবচেয়ে সুন্দর রূপ। 'সভ্যতা' ক্ষমতার কাছে বিক্রি হলেও 'সৌন্দর্যতা' কখনো হয়নি ,হবেও না।

সবশেষে, সমাজের ফাটল থেকে আকাশ দেখতে চাওয়া সেইসব শিল্পীদের প্রতি...



"আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,

আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।

আমি মানব দানব দেবতার ভয়,

বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,

জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,

আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!

আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! 
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,


আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর –


বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!"

                                                                                                       কাজী নজরুল ইসলাম
                                                                                         


বি দ্রঃ এটা বোধহয় সিনেমা বিশ্লেষণ থাকলো না। হয়তো সিনেমার বিশেষণে সমাজ বিশ্লেষণ হল।



***


























































Comments

Post a Comment

Popular Posts

Wave Us @