Be Our Friend

লালকাঁকড়ার দেশে আমরা


                                                                                               (অনন্তা বিশ্বাস ) 




"যুগ যুগান্তর  ধরি যোজন যোজন 
ফুলিয়া ফুলিয়া ওঠে উত্তাল  উচ্ছাস- 
অশান্ত বিপুল প্রাণ করিছে গর্জন, 
নীরবে শুনিছে তাই প্রশান্ত  আকাশ" 
                                     -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

মুদ্রের প্রতি আকর্ষণ জন্মেছিলো আমার সেই কোন ছোটবেলায়। তারপর থেকে ঘুরে বেড়িয়েছি না জানি কত সমুদ্র তীরে। দেখার সাধ মিটেছে ,কিন্তু আশা মেটেনি আজও।
ওই দিগন্ত বিস্তৃত নীলজলরাশির সামনে দাঁড়ালে কত ক্ষুদ্র মনে হয় নিজেকে ,তুচ্ছ চাওয়া পাওয়ার গন্ডি পেরিয়ে মনমাঝি পারি দেয় কোন সুদূরে, মন ভরে ওঠে নির্মল আনন্দে ।

 সেই দুর্নিবার আকর্ষণে সাড়া দিয়েই নভেম্বের  এক হিমেল ভোরে লেপের উষ্ণ আমেজ উপেক্ষা করে আমরা জনা আষ্টেক দল সপ্তাহান্তের ছুটিতে রওনা দিলাম নিরালা সমুদ্র সৈকত তাজপুরের উদ্দেশ্যে। আমরা মানে আমি , আমার মা, দিদা, ছোটবেলার বান্ধবী সুকন্যা ,ওর বাবা মা , কান্তি কাকু, কান্তি কাকিমা। নির্ধারিত দিনে হাওড়া থেকে তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেসে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। যাত্রাপথ ভোরে রইলো অজস্র আড্ডা খুনসুটিতে। আমি আর সুকন্যা বসলাম পাশাপাশি দুটি সিটে ,বাকিরা একটু দূরে।গাড়ি চলতেই শুরু হলো আমাদের হাতের কাজ ,টপাটপ মুখে পড়ছি হাওড়া স্টেশন থেকে কেনা আলুভাজা যার পোশাকি নাম 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস'। যতই ট্রেন এগিয়ে চললো আমাদের খিদে আর সেলফি তার সাথে দ্বিগুন হারে বেড়ে চললো। রামনগর পৌছালাম যখন , বেলা প্রায় ১১ টা বাজে। স্টেশনটি অত্যন্ত নির্জন ,মানুষজন প্রায় নেই বললেই চলে । নির্জন সমুদ্র সৈকতে এসেছি এমনটাই তো স্বাভাবিক।শহুরে কোলাহলে অভ্যস্ত মন তবুও অবাক হলো ।
যাইহোক, স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখি গাড়ি নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষারত কয়েকজন ড্রাইভার । ওরই  একটি গাড়ি বেছে নিয়ে রওনা দিলাম বুক করা রিসর্টের উদেশ্যে । দুপাশের পথের শোভা করলাম ক্যামেরা বন্দি। যাত্রা পথে আলাপ হলো ড্রাইভার তরুণটির সাথে । ওনার কাছ থেকেই জেনে নিলাম কাছাকাছি ঘোরার জায়গা গুলো ।রিসর্টের সামনে যখন গাড়ি এসে থামলো প্রায় ১২ টা বেজে গেছে। 
ড্রাইভারকে খুশিমনে বিদায় দিয়ে গেট পেরিয়ে সদলবলে  ঢুকতেই অবাক! ঝাঁ চকচকে নয় অথচ কি সুন্দর সাজানো গোছানো ছবির মতো পরিবেশ। ঢুকেই সামনে প্রশস্ত রাস্তার দুদিকে সাজানো সারি সারি ফুলের টবটার শেষে একটি সুন্দর টিনের চালা দেওয়া খাবার ঘর । রাস্তার বাঁদিকে প্রশস্ত মাঠ ,তাতে রয়েছে বিনোদনের নানান ব্যবস্থা ; বাচ্চাদের স্লিপ ,ঢেঁকি দোলনা ,গাছের সাথে বাঁধা দড়ি দোলনা ,সবার বসে গল্প করার মতো খড়ের ছাউনি দেওয়া খোলা কুঁড়ে।
ডানদিকে রঙিন বেড়া দেওয়া বাগান তাতে নানারকম মৌসুমী ফুল ফুটে রয়েছে। কত গুলো মোরগ হেটে বেড়াচ্ছে ইতিউতি। বাগানের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে মূল বিল্ডিং, ওখানেই রিসেপশন আর থাকার ঘরগুলো।এমনকি এর পাশে ঘোলা জলের মাছ ভর্তি পুকুরও  আছে। পর্যটকের বিনোদনের জন্য ওখানে আছে বোটিংয়ের ব্যাবস্থাও।
কিন্তু শুধু সৌন্দর্য দেখে মন ভরালে তো হবে না।,পেট তখন চুঁইচুঁই ,জানান দিচ্ছে বারবার। অগত্যা লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে লাগেজ নিয়ে চললাম নিজ নিজ ঘরে । সবাই মিলে গুছিয়ে নিয়ে স্নান করে বসলেই খিদে তা আরো চাগার দিলো। গুটিগুটি পায়ে রওনা দিলাম খাবার ঘরের উদেশ্যে। পমফ্রেটের ঝাল সহযোগে হলো দুপুরের ভোজ।

খাওয়ার শেষে এবার ঘোরার পালা। রিসর্টের সামনে গাছপালা ঘেড়া সরু মাটিররাস্তা একটু এগিয়ে শেষ হয়েছে বড়ো পিচের রাস্তায় ,উপনদীর মতো । দূর থেকে শোনা যায় সমুদ্রের গুরু গম্ভীর গর্জন।একাকী  সমুদ্রের সেই ডাক ঘন হয়ে  দাাঁড়িয়ে থাকা ঝাউগাছ পৌঁছে দেয়  কানে ।
ঝাউবন 
 সেই ডাকে সাড়া দিতে দ্রুতপায়ে ঝাাউবন পেড়িয়ে সমুদ্রতটে পৌঁছিয়ে দেখি দূরে কয়েকটা গুমটি ছাড়া আর জনপ্রাণী নেই। প্রশান্ত এই ধ্যানগম্ভীর সমুদ্র পছন্দ করে নির্জনতা। যেন যুুুগ যুগান্তর ধরে ধ্যানমগ্ন কোনো ঋষি।কোলাহলমুখরতা, সমস্ত জাগতিক নিয়মকানুনের  উর্দ্ধে উঠে এ এক অন্য পৃথিবী।
সমুদ্র আর তীরের এই ঝাউবন মিলে যে স্বর্গ রচনা করেছে তাতে এই ইতস্তত দূরে দূরে দাঁড়ানো ছোট্ট বাঁশের তৈরি দোকানগুলি যেন অতিরিক্ত নয়- তা যেন এই প্রকতিরই অঙ্গ। মানুষ এখানে অপাংক্তেয়, অনভিপ্রেত। দূরে ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে বেঁধে রেখে যাওয়া একটি ডিঙ্গি নৌকো। ক্যামেরাবন্দি করলাম নিসর্গ প্রকৃতিকে। তীর ধরে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখা পাওয়া গেল সমুদ্রের এক ছোট্ট বন্ধুর-সে হচ্ছে লাল কাঁকড়া। বড়োই লাজুক তার স্বভাব, এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে আর মানুষের সাড়া পেলেই টুপ করে ঢুকে পড়ছে গর্তে। ঘুরতে ঘুরতে বেলা শেষ হয়ে গেল, গোধূলির রক্তরাগে সেজে উঠল সারা আকাশ। সূর্যদেব তাঁর গোধূলির শেষ আলো দিয়ে সমুদ্র ঋষির চরন ছুঁয়ে প্রনাম জানিয়ে বিদায় নিলেন অস্তাচলে।
ডিঙিনৌকা 
তার সাথে এবার আমাদের ও ঘরে ফেরার পালা। সমস্ত দিনের ক্লান্তি মুছে গেছে ইতিমধ্যেই, মন ভরে উঠেছে এক অনিন্দ্য অনূভূতিতে। সন্ধ্যেবেলাটা কাটলো গল্পে গুজবে আর গরম কফির ধোঁয়ায়। রিসর্টের বাগান তখন ঝলমল করছে ইলেকট্রিক আলোয়, রিসেপশনে বাজছে হিন্দি গান। চাদর গায়ে অলস পায়ে ঘুরে এলাম রিসর্টের ভেতর। ফটো ও তুললাম কিছু। রাতে রিসর্টের বাইরে ঘোরা খুব একটা সুরক্ষিত নয় বললেন ম্যানেজার কাকু। রাত এখানে নিশ্চুপ, সারাদিন তোলা ফোটো দেখে দেখে সময় কাটে না আর, গল্প গুজবের রেশ এসেছে আলগা হয়ে, সবার চোখে নামছে ক্লান্তির ঢল। একসময় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে সবাই মিলে হাজির হলাম খাবার ঘরে। ডিমের কারি, আলু ভাজা, ডাল, ভাত বা রুটি দিয়ে ডিনার সেরে যে যার ঘরে এসেই শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়। চোখ জুড়ে নামলো ঘুম। আমার আর সুকন্যার ঘুম যখন ভাঙলো, বেলা প্রায় আট টা। বাকিরা উঠে পড়েছে অনেক আগে, দুই কাকু এরই মধ্যে সেরে এসেছে প্রাতভ্রমন। গাড়ি আসার কথা বেলা ৯ টায়। তাই চটপট উঠে স্নান সেরে সবাই
মিলে পুরি তরকারি সহযোগে প্রাতঃরাশ। আগের দিনের সেই ড্রাইভারদাদা  আসতেই আমরা দুজন চেপেচুপে বসে গেলাম গাড়ির সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে।, আসলে সামনে বসার লোভ ছাড়তে পারি না দুজনেই। আজকের গন্তব্য শঙ্করপুর আর মন্দারমণি।
মন্দারমণি পৌঁছাতে সময় লাগলো প্রায় দেড় ঘন্টা। গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে দেখি এখানকার সমুদ্রতীর তাজপুরের মতো নির্জন নয়, বেশ ভীড় আছে, তবে দীঘা পুরীর তুলনায় কম।শান্ত সমুদ্র। 
ঢেউয়ের সাথে খেলায় মত্ত আমরা ,বেলা যে কত গড়িয়ে গেছে তার খেয়াল নেই। ঘোর ভাঙলো মায়ের ডাকে। সমুদ্রের তীরে একটি অস্থায়ী হোটেলে ভেটকি ,চিংড়ি দিয়ে সারলাম দুপুরের ভোজ। অসাধারণ রান্না!
এবার গন্তব্য শঙ্করপুর। জলসিক্ত জামা শুকালো গায়েই। শঙ্করপুর পৌঁছাতে বেলা প্রায় তিনটের কাছাকাছি । সমুদ্র এখানে উত্তাল। বাঁধানো পারে বসে বিশাল বিশাল ঢেউ দেখতে দেখতে
বাঁধানো পাড় 
উপভোগ করলাম সমুদ্রকে। সঙ্গী ছিল একটি স্থানীয় কুকুর।উন্মত্ত জলরাশি এসে আছড়ে পড়ছিলো পায়ের ওপর। ভালোবেসে ফেললাম শঙ্করপুরের সমুদ্রকে। ইচ্ছা করে বসে থাকি সারারাত,অপলক নয়নে চেয়ে দেখি প্রকৃতির এই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যকে। কিন্তু ড্রাইভার? তাকে যে ফিরতে হবে। রুজিরুটির তাড়নায় যে ঘুরছে তার যে সময় নেই প্রকৃতির রসস্বাদন করার।অগত্যা ফিরতে হবে । ফিরবো বলে উঠে দাঁড়িয়েছি , এমন সময় বিশাল ঢেউয়ের চাদর আছড়ে পড়লো,ভিজিয়ে দিলো সর্বাঙ্গ,ক্যামেরাটিকে পর্যন্ত। সমুদ্র বোধহয় তার অনুরাগ ব্যক্ত করে এভাবেই।
ফেরার পথটিও কম সুন্দর নয়। শঙ্করপুর থেকে তাজপুর ফেরার রাস্তাটিও সমুদ্রের ধার ঘেঁষে। ফেরার সময় নেমে গেলাম তাজপুর বিচ এ। ভরা জোয়ারে সমুদ্র এগিয়ে এসেছে অনেকটা। কালকের দেখা শান্তটি হয়ে উঠেছে ডানপিটে, এ যেন এক চেনা মানবসত্তার বিচিত্র প্রকাশ। নির্জনে তার গর্জন শোনাচ্ছে ভয়ঙ্কর! জলে পা ভিজিয়ে সমুদ্রকে শেষ বিদায় জানিয়ে অপরাহ্নের শেষ আলোকে সঙ্গী করে ফিরে এলাম রিসর্ট এ ।
পরদিন ঘুম ভাঙতেই মন খারাপ। ফিরতে হবে যে আমাদের ,ছেড়ে যেতে হবে এই অনন্ত জলরাশিকে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে , অসম্ভব ভালো কিছু স্মৃতিকে সঙ্গী করে তাজপুর থেকে রামনগর হয়ে যখন ফেরার ট্রেনে উঠলাম,তখন সবার চোখে জল। প্রতিজ্ঞা করলাম যখনই মন খারাপ হবে কিংবা হাঁপিয়ে উঠবো রোজনামচার ব্যস্ততায়, বারে বারে ফিরে আসবো তোমারই কোলে।
 প্রিয় তাজপুর, ভালো থেকো।

***


  • কিভাবে যাবেন?                     
             হাওড়া থেকে প্রায় গোটা সাতেক ট্রেন আছে। 
             সড়কপথে কলকাতা থেকে ১৭২ কিমি , ৪-৪.৫                   ঘন্টা মতো। 
             ধর্মতলার 6no বাসস্ট্যান্ড থেকেও বাস পাওয়া                     যায়। 

  • কোথায় থাকবেন ? 
             অনলাইনে বুকিং সিস্টেম আছে 

          oyorooms hotels-in-tajpur
          trivago for tajpur
         trip advisor for tajpur







Comments

Post a Comment

Popular Posts

Wave Us @